ওহি

নবম শ্রেণি (মাধ্যমিক ২০২৪) - ইসলাম শিক্ষা - Islamic Study - কুরআন ও হাদিস শিক্ষা | | NCTB BOOK
33
33

ওহি (الْوَحْى)

ওহি শব্দটি আরবি। এর অর্থ হলো গোপনে কোনো কিছু জানিয়ে দেওয়া। এ ছাড়াও শব্দটি ইঙ্গিত করা, লেখা এবং গোপন কথা অর্থেও ব্যবহৃত হয়। ইসলামি শরিয়তের পরিভাষায়, আল্লাহ তা'আলার পক্ষ থেকে নবি- রাসুলদের ওপর অবতারিত বাণীকে ওহি বলে।

ওহির প্রকারভেদ 

ওহি দুই প্রকার। যথা:

১. ওহি মাতলু (আল কুরআন) 

২. ওহি গায়রে মাতলু (আল হাদিস) 

১. ওহি মাতলু : মাতলু অর্থ পঠিত, যা পাঠ করা হয়। যে ওহির ভাব, ভাষা, অর্থ, বিন্যাস সকল কিছুই মহান আল্লাহর এবং মহানবি (সা.) তা হুবহু আল্লাহর ভাষায় প্রকাশ করেছেন, তাকে ওহি মাতলু বলে। এটিকে 'ওহি জলি' বা প্রত্যক্ষ ওহি বলা হয়। কুরআন মাজিদ যেহেতু সালাতে তিলাওয়াত করা হয়, তাই আল কুরআনকে ওহি মাতলু বলে। 

২. ওহি গায়রে মাতলু: গায়রে মাতলু অর্থ অপঠিত। যে ওহির ভাব মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে এসেছে, কিন্তু রাসুল (সা.) নিজ ভাষায় তা বর্ণনা করেছেন তাকে ওহি গায়রে মাতলু বলে। একে ওহি খফি বা প্রচ্ছন্ন ওহিও বলা হয়। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর হাদিস এ প্রকার ওহির উদাহরণ। এটি সালাতে কিরআত হিসেবে তিলাওয়াত করা হয় না বলে এটিকে অপঠিত ওহি বলা হয়।

কুরআন মাজিদের বিভিন্ন স্থানে প্রথম প্রকার ওহিকে 'কিতাব' বা গ্রন্থ এবং দ্বিতীয় প্রকার ওহিকে 'হিকমাহ' বা প্রজ্ঞা বলে অভিহিত করা হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন, 'আল্লাহ মু'মিনদের প্রতি অবশ্য অনুগ্রহ করেছেন যে, তিনি তাদের নিজেদের মধ্য থেকে তাদের নিকট রাসুল প্রেরণ করেছেন, যিনি তাঁর আয়াতসমূহ তাদের নিকট আবৃত্তি করেন, তাদেরকে পরিশোধন করেন এবং কিতাব ও হিকমাহ তাদেরকে শিক্ষা দেন, যদিও তারা পূর্বে স্পষ্ট বিভ্রান্তির মধ্যেই ছিল।' (সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ১৬৪)

দ্বিতীয় প্রকারের ওহি 'হাদিস' বা 'সুন্নাত' নামে পৃথক ভাবে সংকলিত ও সংরক্ষিত হয়েছে।

ওহি অবতরণের পদ্ধতি

মহানবি (সা.) এর ওপর বিভিন্ন পদ্ধতিতে ওহি নাযিল হতো। প্রসিদ্ধ মতে মহানবি (সা.) এর ওপর সাত পদ্ধতিতে ওহি নাযিল হয়েছে, যা নিম্নে আলোচনা করা হলো:

১. ঘণ্টা ধ্বনির ন্যায়: এটা ওহি নাযিলের প্রথম পদ্ধতি। রাসুলের নিকট অধিকাংশ সময় এ পদ্ধতিতে ওহি নাযিল হতো। ওহি নাযিলের পূর্বে প্রথমে বিরতিহীনভাবে ঘণ্টাধ্বনির মতো শব্দ আসতে থাকত। মহানবি (সা.) নিজ কানে শুনতেন। এ সময় রাসুলুল্লাহ (সা.) তীব্র শীতের মধ্যেও ঘর্মাক্ত হয়ে পড়তেন। তিনি আরোহী অবস্থায় থাকলে শক্তিশালী উটও ওহির ভার বহন করতে না পেরে বসে পড়ত। ওহি নাযিলের এ পদ্ধতি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর জন্য সবচেয়ে কষ্টকর ছিল।

২. মানুষের আকৃতিতে ফেরেশতার আগমন: হযরত জিবরাইল (আ.) কখনো কখনো মানুষের আকৃতিতে ওহি নিয়ে আসতেন। অধিকাংশ সময় বিশিষ্ট সাহাবী হযরত দাহিয়াতুল কালবি (রা.)-এর আকৃতিতে জিবরাইল (আ.) আগমন করতেন। এ পদ্ধতিতে ওহি রাসুল (সা.) এর জন্য তুলনামূলক সহজ ছিল।

হাদিসে এসেছে

وَأَحْيَانًا يَتَمَثَّلُ لِيَ الْمَلَكُ رَجُلًا

অর্থ: আর কখনো কখনো আমার কাছে ফেরেশতা মানুষের আকৃতিতে আসতেন। (বুখারি)

৩. জিবরাইল (আ.)- এর নিজস্ব আকৃতিতে আগমন: কখনো কখনো হযরত জিবরাইল (আ.) অন্য কোনো রূপ ধারণ না করে সরাসরি নিজ আকৃতিতে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর নিকট ওহি নিয়ে আগমন করতেন। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর জীবনে এরূপ ঘটনা তিন বার ঘটে। প্রথমবার হেরা গুহায় কুরআনের প্রথম ওহি নিয়ে নিজ আকৃতিতে আগমন করেন। দ্বিতীয়বার মি'রাজ রজনীতে, তৃতীয়বার মহানবি (সা.) জিবরাইল (আ.)-কে আসল রূপে দেখার ইচ্ছা পোষণ করায় তিনি নিজস্ব আকৃতিতে আগমন করেছিলেন। 

৪. সত্য স্বপ্ন যোগে: মহানবির প্রতি ওহি নাযিলের সূচনা হয়েছিল সত্য স্বপ্নের মাধ্যমে। কুরআন নাযিলের পূর্বে তিনি যা স্বপ্নে দেখতেন, তা-ই ছিল ওহি। হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) বলেন, 'রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর ওহির সূচনা হয়েছিল ঘুমের মধ্যে সত্য স্বপ্নের মাধ্যমে। তিনি যখনই কোনো স্বপ্ন দেখতেন, তা প্রত্যুষের আলোর ন্যায় বাস্তবে প্রতিফলিত হতো।' 

৫. আল্লাহ তা'আলার সরাসরি কথোপকথন: ওহি নাযিলের আর একটি পদ্ধতি ছিল, কোনো মাধ্যম ছাড়া সরাসরি আল্লাহর সঙ্গে বাক্যালাপ। এই পদ্ধতিকে বলা হয় কালামে ইলাহি। মি'রাজ রজনীতে মহানবি (সা.) সরাসরি মহান আল্লাহর সঙ্গে বাক্যালাপ করেছেন। এ সময়ই উম্মাতে মুহাম্মাদির প্রতি পাঁচ ওয়াক্ত সালাত ফরয করা হয়েছে। 

৬. সরাসরি হৃদয়পটে ওহি ঢেলে দেওয়া: হযরত জিবরাইল (আ.) কখনো সামনে না এসে কোনো মাধ্যম ছাড়া সরাসরি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর অন্তরে আল্লাহর বাণী ফুঁকে দিতেন। এক হাদিসে মহানবি (সা.) নিজেই বলেছেন, 'হযরত জিবরাইল (আ.) আমার মানসপটে ফুঁকে দিয়েছেন।' 

৭. হযরত ইসরাফিল (আ.)- এর মাধ্যমে ওহি প্রেরণ: কখনো কখনো আল্লাহ তা'আলা হযরত ইসরাফিল (আ.)- এর মাধ্যমে মহানবি (সা.)-এর ওপর ওহি নাযিল করতেন।

ওহির গুরুত্ব

ওহির প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা ফরয। এতে অবিশ্বাস বা সন্দেহ পোষণ করা কুফরি। ওহি মানব জাতির ইহকাল ও পরকালের শান্তি এবং কল্যাণের বার্তা নিয়ে আসে। এ বার্তা গ্রহণকারীর জন্য ওহি কল্যাণকর পথ সহজ করে দেয়। আর যারা ওহিকে অবিশ্বাস করে কিংবা অবজ্ঞা করে তাদের জন্য ভয়াবহ শাস্তির ব্যবস্থা রয়েছে। হযরত আদম (আ.) থেকে হযরত মুহাম্মাদ (সা.) পর্যন্ত অগণিত নবি-রাসুল আগমন করেছেন। নবি-রাসুলদের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করার মতো ওহির প্রতিও বিশ্বাস স্থাপন করা আবশ্যক। ইসলামের দৃষ্টিতে সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবি মুহাম্মাদ (সা.)- এর মতো পূর্ববর্তী নবিদের ওপর অবতীর্ণ ওহিকেও সত্যবাণী হিসেবে মেনে নেওয়া ইমানের অংশ।

 

Content added By

Read more

Promotion